ভারতের কর কাঠামোর ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছে। ২০২৫ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত জিএসটি কাউন্সিলের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে, আগামী ২২শে সেপ্টেম্বর থেকে সমগ্র দেশে কেবলমাত্র দুটি প্রধান জিএসটি হার কার্যকর হবে — ৫% ও ১৮%। এর পাশাপাশি বিলাসবহুল ও ক্ষতিকর পণ্যের জন্য বিশেষভাবে ৪০% করের আলাদা ধাপ বজায় রাখা হয়েছে।
এই সিদ্ধান্তকে বলা হচ্ছে ‘জিএসটি ২.০’, কারণ এর ফলে ভারতের কর কাঠামো হবে আরও সরল, স্বচ্ছ এবং ভোক্তাবান্ধব। বর্তমানে জিএসটি-তে চারটি স্তর রয়েছে — ৫%, ১২%, ১৮% ও ২৮%। এগুলি একত্রিত করে আনা হচ্ছে দুই স্তরে, যাতে সাধারণ ভোক্তাদের দৈনন্দিন ব্যবহার্য প্রায় সব পণ্যের উপর করের বোঝা কমে আসে।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ঘোষণা করেছেন —
“আমরা কর কাঠামো সরল করছি। সাধারণ মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিসের উপর কর কমানো হয়েছে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দাম অনেকটাই কমবে। রাজ্যগুলির কোনো আপত্তি ছিল না, সর্বসম্মতভাবেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”
জিএসটি ২.০: কোন কোন স্তর থাকছে কার্যকর
এখন থেকে জিএসটি চার স্তরের বদলে দুই স্তর + একটি বিশেষ ৪০% স্তরে ভাগ করা হবে।
সম্পূর্ণ তালিকা: নতুন জিএসটি হার অনুযায়ী পণ্যের তালিকা
| জিএসটি হার | কোন কোন পণ্য পড়বে |
| ০% (করমুক্ত) | ৩৩টি জীবনরক্ষাকারী ও ক্যান্সারের ওষুধ, বিরল রোগের ওষুধ, ব্যক্তিগত জীবনবিমা, স্বাস্থ্যবিমা, মানচিত্র, চার্ট, গ্লোব, পেন্সিল, শার্পনার, ক্রেয়ন, খাতা, রবার, UHT দুধ, ছানা/পনির (প্যাকেটজাত), রুটি, পরোটা, খাখরা, পিৎজা ব্রেড ইত্যাদি। |
| ৫% | চুলের তেল, শ্যাম্পু, টুথপেস্ট, সাবান, টুথব্রাশ, শেভিং ক্রিম, মাখন, ঘি, চিজ ও ডেইরি স্প্রেড, নোনতা নাস্তা (নমকিন, ভুজিয়া ইত্যাদি), বাসনপত্র, শিশুর বোতল ও ডায়াপার, সেলাই মেশিন, থার্মোমিটার, মেডিক্যাল অক্সিজেন, ডায়াগনস্টিক কিট, চশমা, ট্র্যাক্টর ও যন্ত্রাংশ, জৈব কীটনাশক, ড্রিপ সেচ ব্যবস্থা, মাটি প্রস্তুতির কৃষিযন্ত্র ইত্যাদি। |
| ১৮% | পেট্রল ও হাইব্রিড গাড়ি (১২০০ সিসি ও ৪০০০ মিমি পর্যন্ত), ডিজেল হাইব্রিড (১৫০০ সিসি পর্যন্ত), তিন চাকার গাড়ি, মোটরসাইকেল (৩৫০ সিসি পর্যন্ত), পণ্য পরিবহনের যান, এয়ার কন্ডিশনার, টিভি (৩২ ইঞ্চির বেশি), প্রোজেক্টর, ওয়াশিং মেশিন, বড় ট্রাক্টর ইত্যাদি। |
| ৪০% (বিশেষ স্ল্যাব) | পান মশলা, সিগারেট, গুটখা, চিউইং টোব্যাকো, বিড়ি, চিনি মেশানো বা ফ্লেভারযুক্ত এয়ারেটেড ওয়াটার, কফি-ভিত্তিক বেভারেজ, উচ্চমানের মোটরসাইকেল (৩৫০ সিসির বেশি), ব্যক্তিগত ব্যবহারের এয়ারক্রাফ্ট, ইয়ট, পিস্তল, জুয়া, ক্যাসিনো, লটারি, অনলাইন গেমিং ইত্যাদি। |
কোন খাত কতটা লাভবান হল
১. স্বাস্থ্য খাত
স্বাস্থ্য খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এই সংস্কারে। আগে স্বাস্থ্যবিমা ও জীবনবিমার প্রিমিয়ামের উপর ১৮% জিএসটি বসত। ফলে মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য বিমা নেওয়া অনেক সময় কঠিন হয়ে যেত। এখন এগুলিকে সম্পূর্ণ করমুক্ত (০%) করা হয়েছে।
এছাড়াও মেডিক্যাল অক্সিজেন, থার্মোমিটার, গ্লুকোমিটার, টেস্ট স্ট্রিপ, স্পেকট্যাকলস ও ডায়াগনস্টিক কিটের উপর কর কমিয়ে ৫% করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর ফলে স্বাস্থ্যসেবার খরচ কমবে এবং সাধারণ মানুষ আরও সহজে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা পাবেন।
২. কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি
কৃষি যন্ত্রপাতি, সেচ ব্যবস্থা, অর্গানিক কীটনাশক, ড্রিপ সেচ সরঞ্জাম ইত্যাদির উপর কর ৫% করা হয়েছে। এর আগে এগুলির উপর ১২% কর বসত।
এই সিদ্ধান্তকে কৃষকদের জন্য ‘বড় স্বস্তি’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। কৃষক সংগঠনগুলির মতে, এতে যন্ত্রচালিত কৃষিকাজ সহজতর হবে, উৎপাদন খরচ কমবে এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন গতি আসবে।
৩. খাদ্য ও দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিস
খাদ্যদ্রব্য ও দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসের উপর সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে।
- শূন্য শতাংশ (০%) কর: রুটি, পরোটা, খাখরা, পনির, দুধের মতো মৌলিক খাদ্যদ্রব্য।
- ৫% কর: মাখন, ঘি, চিজ, ডেইরি স্প্রেড, নমকিন, চুলের তেল, শ্যাম্পু, টুথপেস্ট, সাবান, শেভিং ক্রিম।
এর আগে এইসব জিনিসের উপর ১২% থেকে ১৮% কর বসত। এখন সেগুলি কমে যাওয়ায় সরাসরি ভোক্তারা লাভবান হবেন। বিশেষ করে গ্রামীণ ও আধা-শহুরে অঞ্চলে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
৪. অবকাঠামো ও নির্মাণ খাত
সিমেন্ট ও নির্মাণ সামগ্রীর উপর কর ১৮% করা হয়েছে (আগে ছিল ২৮%)। সিবিআরই ইন্ডিয়ার সিইও অঞ্জুমান ম্যাগাজিনের মতে, এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
সাধারণত নির্মাণ প্রকল্পে মোট খরচের প্রায় ৪০–৪৫% সিমেন্ট ও স্টিলের পেছনে খরচ হয়। কর কমে যাওয়ায় প্রকল্পের খরচও কমবে এবং নির্মাতারা এর সুবিধা ক্রেতাদের দিতে পারবেন। ফলে আবাসন খাত সস্তা হবে এবং চাহিদা বাড়বে।
৫. অটোমোবাইল খাত
অটো খাতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে।
- ছোট গাড়ি ও ৩৫০ সিসি পর্যন্ত মোটরসাইকেল: কর ২৮% থেকে কমে ১৮% হয়েছে। এতে মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের জন্য গাড়ি কেনা অনেক সহজ হবে।
- বড় গাড়ি ও হাই-এন্ড বাইক: কর বেড়ে ৪০% হয়েছে।
- ইলেকট্রিক গাড়ি (EV): এখনও মাত্র ৫% জিএসটি।
এর ফলে EV শিল্পকে বড় প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে বিলাসবহুল যানবাহনের উপর করের বোঝা বাড়ানো হয়েছে।
৬. বিলাসপণ্য ও ‘সিন গুডস’
তামাকজাত দ্রব্য, গুটখা, পান মশলা, সিগারেট, এয়ারেটেড বেভারেজ, ইয়ট, প্রাইভেট এয়ারক্রাফ্ট, রিভলভার ইত্যাদির উপর কর ৪০% করা হয়েছে।
সরকারের লক্ষ্য স্পষ্ট — সাধারণ ভোক্তাকে ছাড় দেওয়া হবে, কিন্তু বিলাসী জীবনযাপন বা ক্ষতিকর অভ্যাসকে নিরুৎসাহিত করা হবে।
৭. ভোক্তাদের প্রতিক্রিয়া
সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তি তৈরি হয়েছে। অনেক গৃহিণী জানিয়েছেন, রান্নাঘরের বাজেটে প্রায় ১০–১৫% খরচ কমতে পারে। ছোট ব্যবসায়ীরা বলছেন, নতুন জিএসটি রিফান্ড ব্যবস্থার ফলে ক্যাশ ফ্লো উন্নত হবে।
ডিজিটাল সংস্কার ও ব্যবসায়িক প্রভাব
জিএসটি ২.০ কেবল কর হার পরিবর্তনেই সীমাবদ্ধ নয়; এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একাধিক ডিজিটাল রিফর্ম।
- রিফান্ড সিস্টেমে স্বচ্ছতা: ব্যবসায়ীরা অনেক দিন ধরে অভিযোগ করছিলেন, জিএসটি রিফান্ড পেতে দীর্ঘ সময় লাগে। এবার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে আরও উন্নত করা হচ্ছে যাতে দ্রুত ও স্বচ্ছ রিফান্ড নিশ্চিত করা যায়।
- ফ্রড রোধ: নকল ইনভয়েসের মাধ্যমে ট্যাক্স ফাঁকি রোধ করতে ব্লকচেইন-ভিত্তিক প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু হবে।
- স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজেস (SMEs)-এর সুবিধা: ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য ফাইলিং প্রক্রিয়া সরল করা হচ্ছে। পোর্টাল আরও ব্যবহারবান্ধব করা হচ্ছে যাতে কর জমা দেওয়া ও হিসাব রাখা সহজ হয়।
রাজস্ব ক্ষতি ও সরকারের অবস্থান
একটি বড় প্রশ্ন হল, এই ট্যাক্স কাটের ফলে সরকারের আয় কি কমে যাবে?
অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতে, প্রাথমিক পর্যায়ে সামান্য রাজস্ব ক্ষতি হতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে এর ফলে ভোক্তা চাহিদা ও অর্থনৈতিক কার্যকলাপ বাড়বে। অর্থাৎ, ভলিউম বেড়ে গেলে সরকারের আয়ও ধীরে ধীরে সমান হবে।
অর্থনীতিবিদ মহেশ জয়সিং বলেছেন:
“এই সংস্কার কেবল ভোক্তাদের স্বস্তি দেয়নি, বরং শিল্পক্ষেত্রেও আস্থা বাড়িয়েছে। এটি ভারতের অর্থনীতিকে আরও ভোক্তা-চালিত বৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবে।”
শেয়ার বাজারের প্রতিক্রিয়া
জিএসটি সংস্কারের ঘোষণার পরদিনই বাজারে তার প্রভাব পড়ে।
- সেন্সেক্স ৫৫০ পয়েন্ট বেড়েছে
- নিফটি ২৪,৮৫০-এর ওপরে উঠেছে
- অটো, এফএমসিজি ও ইনফ্রা খাতে শেয়ার সর্বাধিক লাভবান হয়েছে।
বিশ্লেষক সন্তোষ মীনা বলেছেন:
“দ্বি-স্তরীয় কর কাঠামো বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়িয়েছে। টেকনিক্যালি, নিফটি যদি ২৪,৭৭০-এর ওপরে টিকে থাকে, তবে এটি ২৫,০০০ অতিক্রম করতে পারে।”
রাজ্যগুলির প্রতিক্রিয়া
রাজ্যগুলির মধ্যে কোনো বড় মতবিরোধ হয়নি। অধিকাংশ মুখ্যমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এটি একটি সরল ও জনগণমুখী পদক্ষেপ।
তবে কয়েকটি রাজ্য রাজস্ব ক্ষতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কেন্দ্র আশ্বাস দিয়েছে, প্রয়োজনে রাজ্যগুলিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
উপসংহার: জিএসটি ২.০ — এক নতুন সূচনা
ভারতের কর কাঠামো দীর্ঘদিন ধরেই জটিল ছিল। চারটি স্ল্যাব থেকে দুটি স্ল্যাবে আসা নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।
- সাধারণ ভোক্তাদের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য আরও সস্তা হবে।
- ব্যবসায়ীদের জন্য কর ব্যবস্থা হবে আরও সহজ ও ডিজিটাল।
- স্বাস্থ্য, কৃষি ও নির্মাণ খাতে নতুন প্রাণ আসবে।
- রাজস্ব ক্ষতি সাময়িক হলেও অর্থনীতির সামগ্রিক গতি বাড়বে।
এখন দেখার বিষয়, বাজার ও শিল্পক্ষেত্র কত দ্রুত এই সুবিধাগুলি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়।
সংক্ষেপে বলা যায় — জিএসটি ২.০ কেবল কর হ্রাস নয়, এটি ভারতের অর্থনীতিকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, ভোক্তাবান্ধব ও স্বচ্ছ করার একটি বড় পদক্ষেপ।

